লেবানন থেকে সাইফুল রাজীব :লেবাননে গত দেড় বছর ধরে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ডলার সংকট। প্রবাসে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা বুকে চেপে দলবেঁধে লেবানন থেকে নিজ দেশে ফেরত চলে যাচ্ছে বাংলাদেশিরা। পরিবারে সচ্ছলতা আনার আশায় যারা লেবাননে পাড়ি দিয়েছিল, তাদেরকে আজ শূন্য হাতে দেশে চলে যেতে হচ্ছে।একজন প্রবাসীর মাসিক বেতন ৪০০ ডলারের জায়গায় নেমে এসেছে ৮০ ডলারে। খাবার খরচ ও ঘরভাড়া পরিশোধ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। হাতে নগদ অর্থ না থাকায় দেশে পরিবারের কাছে অর্থ পাঠানো তো দূরের কথা, অনেককে দেশ থেকে উল্টো অর্থ আনতে হচ্ছে।
মাদারীপুরের সীমা বেগম গৃহকর্মীর ভিসায় ২০১২ সালে লেবাননে আসেন। বৈধভাবে লেবানন আসলেও ১ বছর পর নিয়োগকর্তার বাসা থেকে পালিয়ে অবৈধ হয়ে যান। বাইরে কাজ করে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা উপার্জন ছিল। বৈরুতের ক্লাসিকো স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় দেশে যাচ্ছেন। তাই মাঠে এসেছেন বিমান টিকিট নিতে।
সীমা জানালেন, আগে লেবাননে আমরা প্রতিটি নারী পুরুষ ভালো টাকা উপার্জন করেছি। রীতিমত দেশে পরিবারের কাছে অর্থ পাঠিয়েছি। পরিবারও ভালোই চলছিল। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে লেবাননে ডলার সংকটের কারণে আগের মতো আর অর্থ পাঠাতে পারি না।‘তাই বর্তমানে পরিবার অনেক কষ্টে আছে। আশায় ছিলাম লেবাননের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না। যত দিন যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততই খারাপ হচ্ছে। বর্তমানে কাজের চাহিদা থাকলেও কাজ করে কোনো লাভ নাই। আগে যেখানে দেড় হাজার লিরার বিনিময়ে ১ ডলার পেতাম, এখন সেখানে আমাকে ১০ হাজার লিরা দিয়ে এক ডলার ক্রয় করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, এখন ডলারের কারণে সকল খাদ্যদ্রব্যের দামও ৫ থেকে ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আশা ছিল দেশে যাওয়ার সময় পরিবারের সবার জন্য কেনাকাটা করব। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটাও সম্ভব নয়। তাই পুরাতন জিনিসপত্র নিয়েই দেশে রওনা দিতে হচ্ছে।তাই এই দেশে থেকে আর লাভ নাই। লেবাননে দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনের কারণে আমাদের যতটা না ক্ষতি হয়েছে, তার থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে একমাত্র ডলারের কারণে। আমার মতোই এখন সবার অবস্থা। যদি আবার কোনো এক সময় লেবাননের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, তাহলে পুনরায় দেশটিতে আসার ইচ্ছে আছে।
যারা বাংলাদেশ দূতাবাসে স্বেচ্ছায় নাম নিবন্ধন করে দেশে যাচ্ছেন তারা সবাই একই সুরে কথা বলেছেন। সমস্যা একটাই। সেটা ডলার সংকট।বাংলাদেশিরা বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাসে বিমান টিকিটি বাবদ ৪শত মার্কিন ডলার পরিশোধ করে নাম নিবন্ধন করেছি। বর্তমানে এই ৪শত ডলার যোগাড় করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তারপরও মনে একটাই স্বান্তনা যে দূতাবাসের সহযোগিতায় জেল জরিমানা ছাড়া স্বল্প সময়ে দেশে পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারছি।
লেবাননের এমন সঙ্কট তাই বাধ্য হয়ে বৈধ ও অবৈধ সকল বাংলাদেশিরা দলে দলে লেবানন ত্যাগ করছে। আবার এমন অনেক বাংলাদেশি আছেন, যারা এখনো দেশটিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশায় দিন গুনছেন।লেবাননে গত ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশ দূতাবাসের স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার জন্য বিশেষ কর্মসূচির আওতায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি নাম নিবন্ধন করে। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে ২ হাজার ৫৩৮ জন বাংলাদেশি দূতাবাসের সহযোগিতায় নিজ দেশে ফেরত গেছে।
মার্চ মাসের মধ্যে সবাইকে পর্যায়ক্রমে দেশে পাঠানো হবে বলে জানান রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর আল মুস্তাহিদুর রহমান।বাংলাদেশিরা দূতাবাসের সহযোগিতায় স্বল্প সময়ে দেশে ফিরতে পেরে বাংলাদেশ দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।